মুকুন্দ আমার বন্ধু। অনেকবার ও আমায় বলেছে,তপন,তোর স্কুল দেখতে যাবো--সে সঙ্গে গ্রামও দেখা হোয়ে যাবে।
আমি বলি,আয় না,বন্ধুরা মিলে পিকনিকও করতে পারি ওখানে।
মুকুন্দ প্রায়ই বলত কথাটা,তোর স্কুলের গ্রাম দেখতে যাবো রে !গত তিন মাসে অন্তত দশবার ও একথা বলেছে।
আমার কাছেও গ্রামটা ভালো লাগে। আসলে গ্রাম নয়,ওটা একটা ট্রানজিট ক্যাম্প। তবে গ্রামের মত সাজানো গছানো। চারদিকে জঙ্গল আর জঙ্গল। অনেক দূর দূর মাঝে মাঝে আদিবাসী গ্রাম। গ্রামের আশপাশে ফসলের খেত। কিছু দূরে ছোট এক নদী বয়ে চলেছে।
আমি মুকুন্দকে গ্রামের গল্প করি। ওর খুব ভালো লাগে। উত্সাহ নিয়ে বলে ওঠে,এক দিন ঠিক যাবো তোদের স্কুলের গ্রাম দেখতে !
আমি প্রমোদ,দীপক,মুকুন্দ,ভোলা অন্য সব বন্ধুদের আমার স্কুল ও গ্রামের গল্প করেছি।
আমি তখন মধ্য প্রদেশের বস্তার জেলায় ছিলাম। বর্তমানে সে জাগা ছত্তিস গড় প্রদেশের অন্তর্গত। বস্তার জেলার ছোট আদিবাসী গ্রাম,বেনিয়া গাঁও। এখানে দণ্ডকারণ্য পরিকল্পনার এক উদ্বাস্তু শিবির ছিল।
বাংলা দেশ থেকে আসা উদ্বাস্তু পরিবারের পুনর্বাসন দেবার আগে কিছু দিন অস্থায়ী ভাবে তাদের থাকার ব্যবস্থা হতো এই শিবিরে। শিবিরের নাম আদিবাসী গ্রামের নাম হিসাবে রাখা হত। সে ভাবে নাম হল,বেনিয়াগাঁও ক্যাম্প। ক্যাম্পের পরিবারদের অনেক সময় দীর্ঘ দিনও এখানে অতিবাহিত করতে হত। সময়টা ছ মাস থেকে শুরু করে অনেক ক্ষেত্রে এক বছরের ওপরও ঘুরে যেত।
বেনিয়াগাঁও ক্যাম্পে সরকার খুলে রেখে ছিল--প্রাথমিক স্কুল। এখানকার স্কুলেই আমি শিক্ষকতা করতাম। পঞ্চাশ পরিবার বাস করার মত ঘর তৈরি আছে এখানে। টিনের চাল আর দরমার ঘেরা দেওয়াল। অস্থায়ী ঘর বলা যায়। ঘরগুলি ছিল ক্যাম্প এরিয়ার শেষ সীমানায় বর্গাকারে বসানো। মাঝ খানটাতে স্কুল ঘর। স্কুল ঘরের পাশে ছিল শিক্ষকের কুয়াটার। স্কুল ঘর ও কুয়াটারও টিনের চালায় দরমার ঘেরায় তৈরি। খুব একটা সুরক্ষিত নয়।
গরীব গৃহ হারাদের ঘরে কিই বা থাকবে ! আর তখনকার দিনে গরীব মাস্টারের কথা তো প্রচলিত ছিলই ! কাজেই সুরক্ষার খুব পোক্ত প্রয়োজন ছিল না।
তখন আমি অবিবাহিত ছিলাম। বেনিয়া গাঁও থেকে এগারো কিলো মিটার দূরে মা,বাবা,ভাই,বোনদের কাছেই থাকতাম। বাবা কোন্ডাগাঁও শহরের কোন অফিসে চাকরি করতেন। আমরা বাবার অফিস থেকে পাওয়া কুয়াটারে থাকতাম। প্রতিদিন স্কুলে কোন্ডাগাঁও থেকে সাইকেলে যাতায়াত করতাম। বেলা দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত স্কুল করে আবার কোন্ডাগাঁও নিজেদের কুয়াটারে ফিরতাম।
চাকরির প্রথম যে দিন জয়েন করতে গেলাম মনে হল আমি কোন দ্বীপান্তরে এসে পড়েছি ! সাইকেলে এন.এচ.৪৩ ধরে চলেছি তো চলেছি--পথের আর যেন শেষ নেই! এগারো কিলো মিটারের আন্দাজ তখন ছিল না। রাস্তার দু পাশে জঙ্গল আর জঙ্গল। এই এগারো কিলোমিটারের মধ্যে রাস্তার ধারে মাত্র দুটো আদিবাসী গ্রাম পড়েছিল। প্রথমটির নাম ভেলুয়া পদ,দ্বিতীয়টির নাম হরিগুনি.তার পর বেনিয়াগাঁও।
দিনের বেলা ক্যাম্প এরিয়াতে মানুষের কথাবার্তা,সামান্য কোলাহল আর সদর রাস্তার চলা গাড়ির আওয়াজ শোনা যায়। আর রাতে সে এক ভয়াবহ ব্যাপার ! ক্যাম্পের লোকেরা সন্ধ্যের পর থেকেই ঝিমোতে থাকে। যে টুকু সামান্য আওয়াজের সৃষ্টি হত তা মনে হত বহু দূর থেকে আসছে-- অনেকটা প্রতিধ্বনির মতো আসছে বলে মনে হত ! হ্যাঁ,পাশের বড় রাস্তা দিয়ে মাঝে মধ্যে বন,লোকালয় কাঁপিয়ে বেশ অনেক সময় পর পর হলেও ট্রাক কিম্বা বাস বেরিয়ে যেতো।
রাত গভীর হতে থাকে আর নিঝুম হতে থাকে সব কিছু। জোনাকির আলো আর ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কিছু শুনতে বা দেখতে পাওয়া যায় না।
রোজ সাইকেলে যাতায়াত করতাম। প্রায় মাস তিন হয়ে যাবার পর ঠিক করলাম সপ্তাহে এক দু দিন ক্যাম্পে থেকে যাবো। এর প্রধান কারণ হল যে রোজ এগার এগার বাইশ কিলোমিটার সাইকেলিং করা আমার পক্ষে বড় শারীরিক পীড়াদায়ক বলে মনে হচ্ছিল।
মাও বললেন,তপন,এতটা পথ রোজ যাতায়াতে তোর শরীর খারাপ হোয়ে যাচ্ছে। সপ্তাহে এক দু দিন তোকে ক্যাম্পেই থাকতে হবে।
খুব খারাপ লাগছিল আমার। বাড়ি ছেড়ে বাইরে কখনো থাকি নি। আর থাকতে হলে রান্না,খাওয়ার ব্যবস্থাও তো করতে হবে ! এন.এচ.৪৩ রাস্তায় বাসের যাতায়াত ছিল বটে তবে আমার যাতায়াতের অর্থাৎ ডিউটি এটেন্ড করার মত সময়ে বাস নেই বললেই চলে।
অগত্যা পোটলা পাটলি নিয়ে পৌঁছলাম ক্যাম্পে। ওখানকার দু চার জন লোক এসে ঘর ঝাড়ু পোছা করে,ঘরের আশপাশের ঝোপ ঝাড় সাফ করে দিয়ে গেলো। আমি আমার ঘর থেকে আনা জিনিস পত্র নিয়ে উঠলাম স্কুলের কুয়াটারে।
সবচে বড় কথা আমি স্কুলে একা টিচার। আমার আগে যিনি ছিলেন তাঁর বদলি হয়ে যায়। তাঁর কাছ থেকে আমি চার্জ নিয়ে তাঁকে রিলিফ করে দিই।
কোন্ডাগাঁও তাও ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা ছিল। আর এই জঙ্গলে তা কল্পনার বাইরে। আমি টেবিল ল্যাম্প সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। এ ছাড়া তরিতরকারি,সামান্য চাল,ডাল,আলাদা থাকতে গেলে অতি প্রয়োজনীয় যা যা লাগতে পারে প্রায় সব জিনিস মা আমার সঙ্গে দিয়ে দিয়ে ছিলেন।
রোজ স্কুল থেকে ফিরি সন্ধ্যের আগে। তাই সন্ধ্যে আর রাতের এই ঘন জঙ্গলের ক্যাম্পের অবস্থার কথা ধারণাই করতে পারি নি। দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত স্কুল করলাম। মাঝে আধ ঘণ্টা টিফিনে ঘর থেকে আনা খাবার খেলাম। সেই খাবার থেকে কিছু বাঁচিয়ে রাখলাম রাতের খাওয়াটা চালিয়ে নেবো বলে।
সন্ধ্যের আগেই টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে ডিম করে রাখলাম।
ক্লাস ফোরের ছাত্র,নাম অভয়। তাকে বললাম,কি রে রাতে আমার সঙ্গে থাকতে পারবি ?
ও বলল,দেহী,ঘরে জিজ্ঞাস কইরা লই !
তার মানে অভয় রাতে এসে আমার সঙ্গে থাকবে বলে কোন ভরসা নেই!
তবু ওর আসার অপেক্ষা করছিলাম।
ও আসলো না। নতুন কেনা হাত ঘড়িটায় দেখলাম রাত আটটা বাজে। না,ও আসবে না। দেখলাম,সন্ধ্যের পর থেকেই জাগাটা আশ্চর্য রকম ভাবে চুপ চাপ হয়ে যেতে লাগলো। ক্যাম্পে তিরিশ ফ্যামিলির মত লোকের বাস। গুনলে একশ লোকের বেশী তো হবেই। কিন্তু কোথায় ওরা ! রাত আটটায় সব স্তব্ধ হয়ে গেলো। আমার ঘরের তিনটে জানালার একটার একটা পাট খোলা রেখেছি। সেখান দিয়ে বাইরের দিকে একবার তাকালাম। নিকষ কালো অন্ধকার ! একটু দূরে চোখ রাখতেই দেখলাম,ফুট করে হঠাৎ ফুটে উঠলো আলোর ছটা। আসলে পথ ভোলা জোনাকির একটা দুটো লোকালয়ের আশপাশে এসে গিয়েছে। আর স্তব্ধতা ঘিরে ঝিঁঝি শব্দের রেশ আরও যেন ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছে!
একা রাত কাটাতে পারব কি না ভাবছিলাম। কিন্তু তখন কিছু করার ছিল না। আমার ঘর থেকে চার দিকের বসত ঘরগুলির দূরত্ব অন্তত হাজার গজের মত হবে। রাত আটটা মানে এখানকার মাঝ রাত মনে হচ্ছে। একটা লোকেরও সাড়া শব্দ নেই। দূরে একবার মাত্র ছোট বাচ্চার কান্নার ক্ষীণ আওয়াজ কানে এলো। জানলার একটা পাট বন্ধ করি নি,তার এটাও আর এক কারণ ছিল,আমার মনে হয়েছিল কোন রকম ভয়ের পরিস্থিতি যদি উৎপন্ন হয় তবে চীৎকার চেঁচামেচি করে লোক ডাকার এটাই এক মাত্র রাস্তা !
সামনের রাস্তা দিয়ে গোঁ গোঁ করতে করতে ট্রাক চলে গেল। লাইটের ফোকাস যেন বন জঙ্গলকে চমকিয়ে ধাঁধিয়ে দিয়ে চলে গেল। আবার শূন্যতা—শব্দ,আলোর অভাব অনুভূত হয় !
ভয় আমার নেই এ কথা বলব না। মনের মধ্যে একবার ভয় যদি ঢুকে যায় তা ক্রমশ বেড়েই যেতে থাকে।
নিঝুম রাতের স্তব্ধতায় ঝিঁঝি পোকার ডাক যেন কোন বিশেষ অর্থবহ হয়ে ওঠে ! মনে হয় এই জঙ্গলের রাতে নির্জনতা কি মানুষের মত জেগে ওঠে ! মানুষের বুকে যে হার্ট ধুক ধুক চ'লে জীবনের লক্ষণ দর্শায় তেমনি রাতও কি তার ঝিঁঝি-তান নিয়ে জেগে ওঠে !
মনের ভয় বড় জেঁকে আসছিল। ঘর থেকে ঠাণ্ডা বাঁচাবার জন্যে আনা পাতলা কম্বলে আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে থাকলাম।
ঘুম আসছিল না। গাছের পাতার নড়েচড়ে ওঠার সামান্য শব্দ,হাওয়া বয়ে যাওয়ার শন শন শব্দ আমার স্পর্শ ইন্দ্রিয়কে যেন দ্বিগুণ সচেতন করে তুলেছে ! মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল বাইরে কারা যেন ফিস ফিস কথা বলছে।
এভাবে এক সময় আমি ঘুমিয়ে গেলাম।
তখন মাঝ রাত হবে। আমার ঘুম ভেঙে গেলো। হ্যাঁ,স্বপ্ন নয়। আমি স্পষ্ট শুনতে পারছি। দরজায় কেউ যেন ঠুক ঠুক শব্দ করছে। কি করি এখন ! মনে মনে ঠিক করলাম,দরজা খোলা যাবে না। চুপ চাপ কম্বল মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকলাম। এক আধ মিনিট পর পরই দরজায় ঠুক ঠুক শব্দ হয়ে যাচ্ছে। এবার আমি চীৎকার করে উঠলাম--কে,কে দরজায় ?
--আমি,কেউ যেন অস্পষ্ট গলায় বলে উঠলো। নাকি আমার মনের ভুল ! আমি ভয়ে এমনি শুনলাম ?
হঠাৎ আমার কাছাকাছি জানালা ছাড়িয়ে দরজার পাশের জানালায় শব্দ হল--যেন কেউ তাতে হাত দিয়ে থপ থপ করছে ভয়ে আমি জোরে,কে ? বলে চীৎকার করে উঠলাম।
--আমি রে ! কথা কটা এবার আমি সত্যি শুনতে পেলাম।
এবার আরও ভয়ের ব্যাপার ঘটল। জানালাটা ফট করে খুলে গেলো। আমি অন্ধকারে কোন মনুষ্য মূর্তির ছায়া মত দেখতে পেলাম।
--তপন ! আমি,দরজা খোল,স্পষ্ট কথাগুলি শুনতে পেলাম আমি। মনে হল,গলার স্বরটা যেন ভালো ভাবে চিনি। কিন্তু এমত অবস্থায় মনে করার ধৈর্য আমার ছিল না। আবার চীৎকার করলাম,কে,কে কথা বলছ ?
--তপন ! আমি মুকুন্দ,তোর বন্ধু রে ! বাইরে থেকে আওয়াজ এলো,দরজা খোল,ভয় পাস না।
--আরে মুকুন্দ,কিন্তু এত রাতে ও কি ভাবে আসবে এখানে ! আমার মাথা কিছু কাজ করছিল না।
--এসে পড়লাম--তুই অনেকবার বলেছিলি না ! দরজা খোল এবার। মুকুন্দ কথা কটি বলে আবার দরজায় ধাক্কা দিলো।
এবার একটু আশ্বস্ত হলাম আমি। আমার বেশ কাছের বন্ধু মুকুন্দ। ও প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসে। আমিও ওদের ঘরে যাই। এ ছাড়া অন্যান্য বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে মিলে আমরা ক্রিকেট খেলি। কিন্তু এত রাতে কি করে এলো এখানে ! যাই হোক,দরজা ধীরে করে খুললাম। দেখলাম,হ্যাঁ,ভয়ের কিছু নেই। মুকুন্দ এসেছে,এত রাতে ? আমার মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে এলো।
ও ম্লান হাসল,বলল অনেক দিনের ইচ্ছে পূর্ণ করবো ভাবছিলাম। আবার কবে আসতে পারি,না পারি--বলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল মুকুন্দ। তারপর বলল,এক গ্লাস জল দে আগে--সব কথা বলছি তোকে। ঘরের মেঝেতেই লেপটি মেরে বসে গেলো ও।
আমি বললাম,বিছানায় এসে বস !
ও বলল,না রে,নোংরা গা হাত পায়ে তোর বিছানা নষ্ট করবো না।
আমি গ্লাসে জল ভরতে ভরতে বলে উঠলাম,কিন্তু রাত তো অনেক,তোকে শুতে তো হবেই।
--না,না,শুবো না রে,তোর গ্রামটা দেখতে এসেছিলাম। তোর সঙ্গেও একবার দেখা করবো ভাবলাম।
জলের গ্লাস মুকুন্দের দিকে এগিয়ে দিলাম। ও বলল,রাখ মাটিতে রাখ।
আমি বললাম,কাল সারাদিন গ্রাম ঘুরে দেখিস। বিকেলে আমার সঙ্গে ঘরে ফিরবি।
--না রে,তা আর হয় না। আমি গ্রাম দেখে নিয়েছি। তোর সঙ্গে দেখা করবো বলে এলাম।
ওর কথাগুলি কেমন যেন হেঁয়ালির মত মনে হচ্ছিল। বললাম,রাতের অন্ধকারে গ্রাম দেখলি কি করে ?
--হ্যাঁ,দেখে নিয়েছি,আলতো হেসে বলে চলল,আজ যেন আমার চোখে অনেক পাওয়ার এসে গেছে। রাতেও অনেকটা দিনের মত দেখতে পারছি। ব্যাপারটা আমি নিজেও বুঝতে পারছি না রে ! জল খেয়ে গ্লাস দূরে মাটিতে রাখল। তারপর নিজের মাথা চেপে ধরল,মাথায় যন্ত্রণা হলে মানুষ যেমন মাথা চিপে ধরে ঠিক তেমনি মুকুন্দ ওর মাথা চেপে ধরে,উঁ,আঃ,বেদনা সূচক শব্দ করে উঠলো।
আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম,কি রে মাথায় কি হল তোর ?
--ব্যথা,ভীষণ ব্যথা রে মাথায় ! বুঝতে পারছি না,মনে হচ্ছে মাথা কিছুতে চেপে গেছে আমার,কথাটা বলে ও উঠে দাঁড়ালো।
আমি বললাম,উঠলি কেন ? রাতটা থেকে কাল বিকেলে যা।
অদ্ভুত হাসল মুকুন্দ,বলল,সে সময় নেই রে ! আমায় যেতে হবে।
আমি আঁতকে উঠলাম,বললাম,কোথায় ?
--কোন্ডাগাঁও--ঘরে।
--বলিস কি ! এত রাতে তুই কি করে যাবি ?
--যে ভাবে এসেছি,ওই যে বললাম অন্ধকারে আমি দিনের মত দেখতে পাই।
--কি বলিস তুই ! আর এখন কোন গাড়ি পাবি তুই ?
--গাড়ি,বলে কেমন যেন হাসল মুকুন্দ। বলল,পা গাড়িতে যাবো। জানিস আমি ইচ্ছে করলে গাড়ির মত ছুটতে পারি--দেখেছি আমি আমার নতুন অভিজ্ঞতায়।
আমার কেমন ভয় করতে লাগলো। মুকুন্দের কথাবার্তা কেমন উড়ো উড়ো ঠেকছিল আমার কাছে ! কেমন অবাস্তব কথাবার্তা বলছে ও !
--চলি রে,বলে,আর কোন কথা না বলে সে হাঁটতে লাগলো। দরজার বাইরে বেরিয়ে দেখলাম মুকুন্দ নেই--যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে !
আমি ডাকলাম,মুকুন্দ ! মুকুন্দ !
--দূর থেকে ওর আওয়াজ পেলাম,চলি রে,আর পেছন থেকে ডাকিস না !
দরজা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলাম.কেমন ভয় ভয় লাগছিল, আর ঘুমোতে পারি নি।
সকাল বেলায় হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় এসে বসলাম। স্কুলের এখনো অনেক দেরী। এখনো দু তিন ঘণ্টা বাকী।
বেলা তখন নটা হবে। আমার এক বন্ধু,ভোলাকে বাস থেকে নামতে দেখলাম।
ভোলাকে দেখে এগিয়ে গেলাম।
বললাম,ভোলা,তুই ?
--হ্যাঁ রে,একটা স্যাড নিউজ আছে !
আমি চমকে উঠলাম। ঘরের কোন খারাপ খবর নেই তো ! ভয়ে ভয়ে ভোলাকে জিজ্ঞেস করলাম,কি খবর বল ?
ও ধীরে ধীরে আমার কাছে এলো,বলল,জানিস,কাল রাতে মুকুন্দ মারা গেছে !
আমি চমকে উঠলাম। আচমকা আমার মুখ থেকে জোরে,কি ?, শব্দ বেরিয়ে এলো।
ভোলা বলল,হ্যাঁ,ও এক্সিডেন্টে মারা গেছে। একটা ট্রাক ওকে চাপা দিয়ে গেছে।
দেখলাম,ভোলা চোখ মুছছে.থেমে ও আবার বলে উঠলো, দেখলাম ট্রাকের চাকায় ওর মাথাটা থেঁতলে গেছে রে !
আমি ততক্ষণে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে গেছি--শোকে, দুঃখে,ভয়ে,আমার গলা থেকে কথা সরছিল না।